ভার্চুয়াল রিয়েলিটিঃ
কম্পিউটার সিস্টেমের সাহায্যে কোন একটি পরিবেশ বা ঘটনার কৃত্রিম ত্রিমাত্রিক রুপায়ন হলো ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (Virtual Reality)। কম্পিউটার প্রযুক্তির সাহায্যে কৃত্রিম পরিবেশকে এমনভাবে তৈরি ও উপস্থাপন করা হয়,যা ব্যবহারকারীর কাছে সত্য ও বাস্তব বলে মনে হয়।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ইতিহাসঃ
১৯৬২ সালে মর্টন এল হেলগি তাঁর তৈরি সেন্সোরামা স্টিমুলেটর নামক যন্ত্রের মাধ্যমে প্রথম ভার্চুয়াল রিয়েলিটির (Virtual Reality) আত্নপ্রকাশ করেন।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে বাস্তব অনুভব করার জন্য তথ্য আদান-প্রদানকারী বিভিন্ন ধরণের ডিভাইস ব্যবহার করা হয়। যেমন-
- মাথায় হেড মাউন্টেড ডিসপ্লে (HMD: Head Mounted Display)
- হাতে একটি ডেটা গ্লোভ (Data Glove) বা হ্যান্ড গ্লাভস
- শরীরে একটি পূর্ণাঙ্গ বডি স্যুট (Body Suit), বুট ইত্যাদি পরিধান করতে হয়।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির বৈশিষ্ট্য সমূহঃ
- এই কৃত্তিম পরিবেশে ত্রি-মাত্রিক ছবি তৈরি হয়।
- কৃত্তিম পরিবেশ হলেও অনুভূতি বাস্তবের মত।
- এই পরিবেশ তৈরির জন্য সংবেদনশীল গ্রাফিক্স ব্যবহার করতে হয়।
- কম্পিউটার প্রযুক্তি ও অনুকরণবিদ্যার (Simulation) প্রয়োগ করা হয়।
- ব্যবহৃত সফটওয়্যারগুলো – Vizard, VRToolKit, 3d Studio Max, Maya ইত্যাদি।
- ভার্চুয়াল রিয়েলিটি অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য, ইন্টারেক্টিভ, কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত, অন্বেষণযোগ্য এবং নিমগ্নযোগ্য হতে হবে।
ICT অধ্যায় ভিত্তিক নোট ডাউনলোড করতে ক্লিক করো
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সিস্টেম তৈরির উপাদান সমূহঃ
১। ইফেক্টরঃ ইফেক্টর হলো বিশেষ ধরণের ইন্টারফেস ডিভাইস যা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি পরিবেশের সাথে সংযোগ সাধন করে। যেমন- হেড মাউন্টেড ডিসপ্লে।
২। রিয়েলিটি সিমুলেটরঃ এটি এক ধরণের হার্ডওয়্যার যা ইফেক্টরকে সংবেদনশীল তথ্য সরবরাহ করে। যেমন-সেন্সর।
৩। অ্যাপ্লিকেশনঃ বিভিন্ন সিমুলেশন সফটওয়্যার সমূহ। যেমন- অটোডেস্কের “Division”।
৪। জিওমেট্টিঃ জিওমেট্রি হলো ভার্চুয়াল পরিবেশের বিভিন্ন বস্তুর বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত তথ্যাবলী।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির (Virtual Reality) প্রকারভেদঃ
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি দুই ধরণের।
- টেলিপ্রেজেন্স (Telepresence)
- সাইবার স্পেস (Cyberspace)
টেলিপ্রেজেন্স (Telepresence):
এই ধরণের ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে ব্যবহারকারীর সামনে দূরবর্তী কোন বাস্তব পরিবেশকে কৃত্রিমভাবে উপস্থাপন করা হয় এবং দূরবর্তী ঐ বাস্তব পরিবেশে একটি রোবট উপস্থিত থাকে। ভার্চুয়াল পরিবেশে ব্যবহারকারী যা করবে, দূরবর্তী স্থানের বাস্তব পরিবেশে অবস্থিত রোবট তার অনুকরণ করে কাজ করবে। এক্ষেত্রে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটারের গ্রাফিক্স ব্যবহারের মাধ্যমে দূর থেকে পরিচালনা করার প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়, যাকে টেলিপ্রেজেন্স বলা হয়।
সাইবার স্পেস (Cyberspace):
এই ধরণের ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে ব্যবহারকারী বাস্তব অথবা কাল্পনিক পরিবেশে অবস্থানের অনুভুতি পায়। সিমুলেশনের ধরণ অনুযায়ী এটি বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে-
নন-ইমার্সিভ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি:
এই ধরণের ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে একটি শক্তিশালী কম্পিউটারের মাধ্যমে ডিসপ্লেতে একটি সিমুলেটেড পরিবেশ তৈরি করে দেখানো হয়। ব্যবহারকারীরা এই পরিবেশকে বিভিন্ন ইনপুট ডিভাইসের মাধ্যমে কন্ট্রোল করতে পারে। যেমন- বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারে মহাকাশ অবলোকন, 3D গেমস ইত্যাদি।
সেমি-ইমার্সিভ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি:
এই ধরণের ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে 3D গ্রাফিক্সের মাধ্যমে আংশিক ভার্চুয়াল পরিবেশ তৈরি করা হয়। এই পরিবেশ তৈরির জন্য হার্ডওয়্যার ব্যবহার করে বাস্তব পরিবেশের মতো অবকাঠামো তৈরি করা হয়। উচ্চ রেজুলেশনের ডিসপ্লে ও কম্পিউটার সিস্টেম ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যবহারকারীকে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির অনুভুতি প্রদান করা হয়। যেমন- বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারে রোলার কোস্টারে পরিভ্রমন, ফ্লাইট সিমুলেশন ইত্যাদি।
ICT অধ্যায় ভিত্তিক নোট ডাউনলোড করতে ক্লিক করো
ফুল-ইমার্সিভ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি:
এই ধরণের ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে সিমুলেশনের মাধ্যমে দৃষ্টি, শ্রবণশক্তি, স্পর্শ, গন্ধ ইত্যাদি অনুভুতির বাস্তব রুপ দেয়া যায়। ফলে ব্যবহারকারী মানসিক ও শারিরীকভাবে সম্পূর্ণরূপে ভার্চুয়াল পরিবেশে নিমজ্জিত হয় এবং পরিবেশের সাথে ইন্টারেক্ট করে থাকে। এই ধরণের পরিবেশে পাখির মতো উড়ার অনুভুতি দেয়।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যবহার/প্রয়োগঃ
প্রকৌশল ও বিজ্ঞানঃ বিজ্ঞানের জটিল বিষয় নিয়ে গবেষণা, গবেষণালব্ধ ফলাফল বিশ্লেষণ ও উপস্থাপন। বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রসেসের সিমুলেশনে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যপক প্রয়োগ রয়েছে।
খেলাধুলা ও বিনোদনঃ ভার্চুয়াল রিয়েলিটির (Virtual Reality) কল্যাণে কম্পিউটারের সাথে কোন খেলায় অংশগ্রহন বা কম্পিউটার সিস্টেমে অনুশীলন সহজ হচ্ছে। দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক সিমুলেশনের মাধ্যমে নির্মিত হচ্ছে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী নির্ভর ছবি যা সবার কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
ব্যবসা ও বাণিজ্যেঃ ভার্চুয়াল রিয়েলিটির (Virtual Reality) মাধ্যমে ভোক্তা বা ক্রেতার কাছে পণ্যের ব্যবহার পদ্ধতি ও অন্যান্য সুবিধাসমূহ সহজে উপস্থাপন করা যায়। এছাড়া ব্যবসায়িক কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান। উৎপাদিত বা প্রস্তাবিত পণ্যের কৌণিক উপস্থাপন ইত্যাদি।
শিক্ষাক্ষেত্রেঃ শিক্ষা গ্রহণ ও প্রদানের ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির (Virtual Reality) অনেক প্রভাব রয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার জটিল বিষয়গুলো সহজে উপস্থাপন এবং পাঠদানের বিষয়টি সহজে চিত্তাকর্ষক ও হৃদয়গ্রাহী করা যায়।
স্বাস্থ্যসেবাঃ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহারের অন্যতম বৃহৎ ক্ষেত্র হচ্ছে চিকিৎসাবিজ্ঞান। এই প্রযুক্তিতে সিমুলেশনের মাধ্যমে জটিল সার্জারি অত্যান্ত সূক্ষভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। চিকিৎসকদের নতুন চিকিৎসা সম্পর্কে ধারণা অর্জন বা প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ড্রাইভিং নির্দেশনাঃ ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে গাড়ি চালনার বিভিন্ন বিষয়ে বাস্তব ধারণা লাভ করতে পারছে ফলে প্রশিক্ষণার্থী দ্রুত গাড়ি চালনা শিখতে পারছে।
সেনাবাহিনী প্রশিক্ষণেঃ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (Virtual Reality) প্রয়োগ করে সেনাবাহিনীতে অস্ত্র চালনা এবং আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহারে কম সময়ে নিখুঁতভাবে প্রশিক্ষণ প্রদান করা যায়।
বিমানবাহিনী প্রশিক্ষণেঃ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রয়োগ করে বিমানবাহিনীতে বিমান চালনা প্রশিক্ষণ এবং প্যারাস্যুট ব্যবহারে প্রশিক্ষণ প্রদান করা যায়।
ICT অধ্যায় ভিত্তিক নোট ডাউনলোড করতে ক্লিক করো
নৌবাহিনী প্রশিক্ষণেঃ নৌবাহিনীতে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ এবং ডুবোজাহাজ চালনা প্রশিক্ষণে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করা হয়।
মহাশূণ্য অভিযানেঃ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (Virtual Reality) প্রয়োগ করে ত্রিমাত্রিক সিমুলেশন তৈরির মাধ্যমে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ছাত্র-শিক্ষকরা সৌরজগৎ এর গ্রহ বা গ্রহাণুপুঞ্জের অবস্থান, গঠনপ্রকৃতি ও গতিবিধি, গ্রহের মধ্যস্থিত বিভিন্ন বস্তু বা প্রাণের উপস্থিতি ইত্যাদি সম্পর্কে সহজেই ধারণা অর্জন করতে পারে।
ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষাঃ ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সাহায্যে যাদুঘরে ত্রিমাত্রিক চিত্রের মাধ্যমে ইতিহাস-ঐতিহ্য উপস্থাপন করা যায়। ফলে আগত দর্শণার্থীরা তা দেখে মুগ্ধ হয় ও বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বাস্তব ধারণা লাভ করে থাকে।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ইতিবাচক প্রভাবঃ
১। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ক্ষেতে জটিল বিষয়গুলো ত্রিমাত্রিক চিত্রের মাধ্যমে আকর্ষণীয় ও হৃদয়গ্রাহী করা যায়।
২। ঝুঁকিপূর্ণ উৎপাদন ব্যবস্থায় ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রয়োগ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সহজ ও সরল করা সম্ভব।
৩। বাস্তবায়নের পূর্বে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সিমুলেশনের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে খরচ কমানো যায়।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির নেতিবাচক প্রভাবঃ
১। বাস্তবের স্বাদ পাওয়ায় কল্পনার রাজ্যে বিচরন করতে পারে।
২। যেহেতু ভার্চুয়াল রিয়েলিটি একটি কম্পিউটার সিস্টেম তাই এটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
৩। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি(Virtual Reality) ব্যয়বহুল হওয়ায় সবাই এই প্রযুক্তি ব্যবহারে সুবিধা পায় না। ফলে ডিজিটাল বৈষম্য তৈরি হয়।